শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩১ অপরাহ্ন
আব্দুর রহমান ঈশান- নেত্রকোণা জেলা প্রতিনিধিঃ
ঘরের বারান্দায় খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে ফুটফুটে এক শিশুকে। এ দৃশ্য দেখে যে কারও মনে হবে ওই শিশুটিকে নির্যাতন করা হচ্ছে। কিন্তু না! বাঁধন খুলে দিলেই নিজের শরীরে নিজেই অনবরত আঘাত করতে থাকে বাকপ্রতিবন্ধী তায়িবা। তাই বাধ্য হয়ে তাকে এভাবে বেঁধে রাখা হয়।
সারাক্ষণ হাত পায়ে বেঁধে রাখতে হয় তাকে। বাঁধন খুলে দিলেই দুই হাত দিয়ে নিজের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সজোরে আক্রমন করতে থাকে। বাধ্য হয়ে মেয়েকে দিন রাত ২৪ঘন্টা হাতপায়ে বেঁধে রাখেন তার পিতা-মাতা। এভাবে জন্মের পর থেকে দুর্বিসহ বন্দী জীবনেই বড় হচ্ছে শিশু তায়িবা।
তায়িবার বাড়ি নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলা ঘাগড়া ইউনিয়নের লেটিরকান্দা গ্রামে। বাবা মাহফুজুর রহমান নয়ন পেশায় একজন দিন মজুর। তিনিও পা এবং কোমরে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। অসুস্থ শরীর নিয়ে কোমরে বেল্ট লাগিয়ে বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। মেয়েকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হয় বিধায় মা আঁখি বেগমও কাজে যেতে পারেন না। আর্থিক অনটনের কারনে মেয়ের উন্নত চিকিৎসাও করাতে পারছেন না।
এই অবস্থায় চোখের সামনে আদরের শিশু সন্তানকে সারাক্ষন বেঁধে রাখার যন্ত্রনা বইতে হচ্ছে তাদের।
সরজমিনে তায়িবাদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়- ঘরের বারান্দায় এক কোনে তায়িবাকে পায়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেই সাথে দুই হাত এক সাথে করে বেঁধে রাখা হয়েছে। পাশে একটি চেয়ার। মন চাইলে সে মাঝে মধ্যে সেখানে বসে। এ ছাড়া সারাক্ষন মাটিতে বসেই সময় কাটে তার।
এ সময় কথা হয় তার মা আঁখি আক্তারে সাথে। তিনি জানান- মেয়েকে সারাক্ষন এভাবে বেঁধে রাখেন। জন্মের পর থেকে বড় হওয়ার সাথে সাথেই অদ্ভুদ আচরণ করতে থাকে তায়িবা। হাতের বাঁধন খুলে দিলেই দুই হাতে নিজের মুখে সজোরে আঘাত করতে থাকে।
তাছাড়া হাতের কাছে কিছু থাকলে তা দিয়েও আঘাত করতে থাকে। পায়ের বাঁধন খুলে দিলে এদিক ওদিক দৌড়ে ছুটে যায়। নিজে তোলে খেতে পারে না। খাবার মুখে দিলে না চিবিয়ে গিলে খায় সে।
এই বাঁধন অবস্থায়ই সে পায়খানা প্রশ্রাব করে। সাথে সাথে পরিস্কার করা না হলে তা খেয়ে ফেলে। রাতে ঘুমানোর সময়ও হাত পায়ে বাধা অবস্থায় বিছানার পাশে বেঁধে রাখতে হয়। বেশিক্ষণ না ঘুমিয়ে এপাশ উপাশ করে।
এ সময় তার হাতের বাঁধন খোলে দেওয়ার কথা বললে তার মা তায়িবার হাতের বাঁধন খোলে দেন। সাথে সাথেই সে দুই হাতে মুখের দুই পাশে থুথুনির নীচে সজোরে অপুর্জপুরি আঘাত করতে থাকে।
যা অত্যন্ন হৃদয় বিদারক। তারপর আবার তার দুই হাত বেঁধে ফেলা হয়। একবার পায়ের বাঁধন খুলে সবার অজান্তে সে অনেক দূরে ছুটে চলে যায়। পরে লোকজন বাড়ীতে দিয়ে যায়। এভাবেই চলছে শিশু তায়িবার বন্দী জীবন।
দিনমুজুর বাবা মাহফুজুর রহমান নয়ন জানান- অভাব অনটনের সংসার তাদের। বাড়ি ভিটি ছাড়া তাদের কোন জমিজমা নেই। বাবার ভিটিতে বড় ভাইয়ের তোলে দেওয়া চালা ঘরে তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন। অভাবের তাড়নায় নিজের কোমরে ও পায়ে জটিল রোগ নিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। এমন অবস্থায় একমাত্র মেয়ে এমন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটে তাদের।
কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি আরও জানান- ইতি পূর্বে অনেক কষ্ট করে টাকা মিলিয়ে কিছু চিকিৎসা করানো হলেও অর্থের অভাবে আর চিকিৎসা করাতে পারেননি। চোখের সামনে শিশু কন্যার এমন যন্ত্রনাদায়ক আচরণ দেখে সহ্য করতে পারেন না। তাই তিনি মেয়ের চিকিৎসার জন্য প্রশাসনসহ সমাজের বিত্তশালীদের প্রতি আহবান জানান।
স্থানীয় বাসিন্দা নবী নেওয়াজ খান জানান- নয়নের পরিবারটি অত্যন্ত দরিদ্র এবং নয়ন নিজেও অসুস্থ। তাদের শিশু সন্তান তায়িবাকে প্রায় ৩/৪ বছর যাবত হাতপায়ে বেঁধে রাখতে দেখছেন। মেয়েটি অদ্ভুদ এক জটিল রোগে আক্রান্ত। তারা আশা করেন উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে মেয়েটি সুস্থ্য হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ জাহিদ হাসান প্রিন্স বলেন- বিষয়টি অত্যন্ত অমানবিক। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে